• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

‘কাজে ফেরো’, আন্দোলনকারীদের আর্জি মমতার

নবান্ন থেকে সদর্থক বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

বিকেল ৪টে ৩২। নবান্নে পৌঁছলেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। ১৭ জনের প্রতিনিধি দল। হাতে অভিযোগের ফাইল, দাবি ১০টি। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক বিকেল ৫টা। নির্ধারিত সময় মতোই নবান্নের সভাঘরে শুরু হল বৈঠক। টানা ২ ঘণ্টার বৈঠক শেষে ‘দিদি’ হিসেবেই ‘ভাই-বোনেদের’ দাবি মেনে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিকাঠামোর উন্নয়ন, থ্রেট কালচার, ব়্যাগিং নিয়ে কড়া নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ডাক্তারদের দাবি মেনে সব কমিটিতেই জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধি রাখা হবে বলে জানিয়ে দিল নবান্ন।

আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। জুনিয়র ডাক্তার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। সোমবার সেই ইস্যুকে সামনে রেখেই বৈঠকে বক্তব্য রাখা শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের কথায়, প্রতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার কারণেই আরজি কর-কাণ্ড হয়েছে।

সোমবারের বৈঠকে ফের ১০টি দাবির কথা তুলে ধরেন আন্দোলনকারীরা। এক এক করে আলোচনা করেন প্রত্যেকটি দাবি নিয়ে। তাঁদের স্পষ্ট দাবি ছিল, স্টেট টাস্ক ফোর্সে চিকিৎসকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। নির্বাচন যত দিন না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কলেজ পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা চালু করতে হবে। মনিটরিং কমিটি ‘সিলেক্টেড’ নয়, ‘ইলেক্টেড’ হতে হবে। সব কমিটিতেই জুনিয়র ডাক্তারদের নির্বাচনী প্রতিনিধিদের রাখতে হবে। বৈঠকে প্রতিটি কলেজে মোট ৫টি কমিটি তৈরির দাবি জুনিয়র ডাক্তারদের। অ্যান্টি ব়্যাগিং কমিটি, গ্রিভ্যান্স সেল, টাস্ক ফোর্স, কলেজ লেভেল কমিটি এবং কলেজ মনিটরিং কমিটি। রয়েছে স্টেট টাস্ক ফোর্সের মতো কলেজেও একটি কমিটি গঠনের দাবি। এই কমিটির সদস্যরাই ঘটনাস্থলে থেকে পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে পারবে।

এ বিষয়ে মুখ্যসচিব বলেন, ‘ইতিমধ্যেই অনেক কাজ এগিয়েছে। প্রত্যেকটি মেডিক্যাল কলেজে যাতে নিরাপদ পরিবেশ বজায় থাকে, তা আমাদেরও চেষ্টা। আমরা স্টেট লেভেল টাস্ক ফোর্স গঠন করেছি। গ্রিভ্যান্স রিড্রেসাল সেল গঠন করা হয়েছে’। তিনি আরও জানান, ইতিমধ্যেই একটি ইমেল আইডি দেওয়া হয়েছে, যেখানে যাবতীয় অভিযোগ জানানো যাবে। ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে কলেজে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ করা হবে বলে জানান পন্থ। মুখ্যমন্ত্রীও ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ করার আশ্বাস দেন। দ্রুত রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে শূন্যপদে নিয়োগের চেষ্টা করছে বলে রাজ্য। ‘শেষ ২ বছরের খাতা দেখলে অনেক কিছুই বের হবে। পরীক্ষা যাতে স্বচ্ছভাবে হয়, তা লক্ষ্য রাখবেন মুখ্যসচিব। পরীক্ষার সময় কেউ যেন ঘাড় ঘোরানোর সুযোগ না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে’। কড়া বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর।

এদিকে টাস্ক ফোর্স নিয়েও অভিযোগ তোলেন বৈঠকে উপস্থিত ডাক্তারেরা। আন্দোলনকারী এক ছাত্রীর অভিযোগ, টাস্ক ফোর্স কী কাজ করছে, তার সদস্য কত জন, সেই সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। এর পরই আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেবাশিস হালদার দাবি করেন, টাস্ক ফোর্সে সব মেডিক্যাল কলেজের প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। এর পর মুখ্যসচিব জানিয়ে দেন, তাতে ৯ জন সদস্য থাকবেন। পাশাপাশি রোগী কল্যাণ সমিতিতেও জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি থাকবেন বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।

নবান্নে বৈঠকে উঠে আসে যৌন হেনস্তার অভিযোগও। ডাক্তারদের অভিযোগ, মেডিক্যাল কলেজগুলিতে শ্লীলতাহানি, যৌন হেনস্তা, তোলাবাজির মতো একাধিক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় ছাত্র-ছাত্রী দের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ জানানোর জায়গা থাকে না। বিশেষ করে সমস্যায় পড়তে হয় ছাত্রীদের। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের মতামতকে স্বাগত জানান। অধ্যক্ষদের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘অনেক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ-সুপার নিজেদের কাজ করেন না। তাঁরা রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন।’

কলেজে কলেজে ব়্যাগিং নিয়ে মুখ খোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তুলে ধরেন থ্রেট কালচারের প্রসঙ্গও। এই সূত্রেই উঠে আসে আরজি করের ৪৭ জন পড়ুয়ার সাসপেনশনের প্রসঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী আরজি করের বর্তমান প্রিন্সিপালকে প্রশ্ন করেন, ‘কীভাবে একা ৪৭ জনকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিলেন? রাজ্য সরকারকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না? এটা থ্রেট কালচার নয়? তদন্ত না করে কাউকে সাসপেন্ড নয়। ইচ্ছে মতো কাজ করবেন না। কেউ কাউকে থ্রেট করবেন না। আমি ক্ষমতায় বলে থ্রেট করতে পারি না’।

এরপরই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের দাবি, যাঁদের সাসপেন্ড করা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। কমিটি তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সাসপেনশন নিয়ে তদন্ত করা হবে। পক্ষপাতিত্ব চলবে না। আগামী দিনে বিষয়টি দেখা হবে। সরকারকে না জানিয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল কীভাবে তৈরি হল? কীভাবে সাসপেন্ড করা হল?’ মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে গ্রিভ্যান্স রিড্রেসাল সেলের সদস্যরা জানিয়ে দেন, ‘সিস্টেম মেনেই সাসপেন্ড’।

আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও অভিযোগের পাহাড়। দুর্নীতি, তোলাবাজি আরও কত কী! নাম না করে ফের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন কিঞ্জল, অনিকেতরা। কলেজ চত্বরে তোলাবাজি-সহ একাধিক অভিযোগ তোলেন তাঁরা। তার পাল্টা দেন মমতাও। স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এর পরই অনিকেত বলেন, ‘আপনার যদি মনে হয় যাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে তারা নির্দোষ, কাউন্সিল ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাহলে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে পারেন’।

টানা ২ মাসের আন্দোলন, অনশনের পর ২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠক। অবশেষে নবান্ন থেকে সদর্থক বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মুখ্যমন্ত্রীর সাফ বার্তা, একদিনে সমস্ত দাবি পূরণ সম্ভব নয়। এর জন্য সময় ও টাকা, দুটোই প্রয়োজন। ধাপে ধাপে সব দাবি পূরণ হবে। শেষে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ডাক দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন তোলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সরকার কাজ করবে কী করে?’

৪৫ মিনিটের বৈঠক গড়ায় ২ ঘণ্টায়। বৈঠক শেষে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, সরকারের তরফে সব রকমের সহযোগিতা করা হয়েছে। আলোচনায় কোনও ফাঁক রাখা হয়নি। মন খুলে সবাই কথা বলেছে। কিন্তু আদৌ কি মন গলেছে আন্দোলনরত ডাক্তারদের? এবার কী সিদ্ধান্ত? ব্যাক টু ওয়ার্ক? নাকি আন্দোলনের ঝাঁঝ আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত? নজর সেদিকেই।