উত্তরের পাহাড়ে প্রজনন হচ্ছে ব্ল্যাক প্যান্থারের। অর্থাৎ কালো লেপার্ডের। পশ্চিমে দার্জিলিং থেকে পূর্বে কালিম্পং -এর পাহাড় সহ বক্সার জঙ্গলে বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা মিলছে এদের। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে একটি নতুন দিক খুলে যাচ্ছে। যা অবশ্যই ইতিবাচক। তাই, পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে বসানো হচ্ছে ট্যাপ ক্যামেরা।
রেড পান্ডা সংরক্ষণে বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে দার্জিলিংয়ের ‘পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক’।
যা নিয়ে উৎসাহিত সংশ্লিষ্ট সব মহল। উৎসাহিত আমাদের মত যাঁরা বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সেচ্ছাসেবক এবং সেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করেন তাঁরাও।
এরই মধ্যে গত সপ্তাহে কার্সিয়াংয়ের রাস্তায় দেখা মিলল কালো চিতার। যাকে বলে ‘ব্ল্যাক পান্থার’। কিছুদিন আগেই ভুটান সংলগ্ন সিকিমের পাহাড়ে অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। ফলে পাহাড় কি বন্যপ্রাণীদের বিচরণের ক্ষেত্রে নিরাপদ হয়ে উঠছে। শুরু হয়ে গেছে চর্চা। অস্বীকার করছেন না বনকর্তারাও।
কোথাও রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কোথাও আবার কালো চিতা, ক্যামেরাবন্দি হচ্ছে একের পর এক বন্যপ্রাণী। গত ১৪ অক্টোবর , সোমবার কার্সিয়াংয়ের বাগোড়ার জঙ্গল সংলগ্ন রাস্তায় মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় বন্দি হয় কালো চিতাটি। জঙ্গল লাগোয়া রাস্তাটি দিয়ে যাওয়ার সময় এক বায়ুসেনা কর্মীর নজরে আসে, ঝোপের মধ্যে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। বিষয়টি ভালো মতো বুঝতে তিনি মোবাইল ফোনের ক্যামেরা সচল করেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর চোখের সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপার করে জন্তুটি। এরপরেই তিনি পরিচিত এক বনাধিকারিককে জানান। পাশাপাশি, ভিডিওটি শেয়ার করেন, যা ভাইরাল হতে বেশি সময় লাগেনি। সত্যতা যাচাই করতে খোঁজখবর শুরু করে দেন বনকর্তারা।
১৫ অক্টোবর,মঙ্গলবার ঘটনাটি সত্য বলে জানানোও হয় কার্সিয়াং বন দফতরের তরফে। আর ওই সময় আমি কার্সিয়াংয়ের ডাউহিলে ‘ফরেস্ট ট্রেনিং স্কুল’-এ। ডাউহিল পাহাড়ারত বনকর্মীরা আগেই আমাকে বলেছিলেন, এখানে বেশ কয়েকটি ‘ব্ল্যাক পান্থার’ রয়েছে। কথা হচ্ছিল কার্সিয়াং-এর ডিএফও দেবেশ পান্ডের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘বিভিন্নভাবে খোঁজখবর করে ভিডিওটির সত্যতা পাওয়া গেছে। একটি, না একাধিক কালো চিতা ওই এলাকায় রয়েছে। তারও খোঁজ চলছে। এর আগেও গিদ্দা পাহাড় এলাকায় কালো চিতার দেখা মিলেছিল।’ ফলে কার্সিয়াংয়ে কালো চিতার প্রজনন ঘটছে কি না, তা নিয়েও খোঁজ শুরু হয়েছে বন দফতরের তরফে।
প্রসঙ্গত কয়েক মাস আগেই ভুটান সীমান্ত লাগোয়া পাকিয়ং জেলার পাঙ্গোলাখা অভয়ারণ্যে ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা পড়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায়। এই বাঘটি নিয়ে ২০১৮ সালের পর তিনটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এছাড়াও কালিম্পংয়ের ল্যাওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে বেশ কয়েক বছর আগেই চারটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সন্ধ্যান মিলেছে। একের পর এক বাঘের সন্ধান মেলায় পাহাড়ি ঠান্ডা ‘বাঘ’ মানিয়ে নিচ্ছে বলে ওই সময় থেকেই আলোচনা চলছিল। কার্সিয়াংয়ে ‘কালো চিতা’র দেখা মেলায় তাতে সিলমোহর পড়ল বলা যায়। কার্সিয়াংয়ের ডিএফও’র মতে, ‘পাহাড়ে একের পর এক বন্যপ্রাণীর দেখা মেলা এবং তা বিরল প্রজাতির হওয়াটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। সে কারণেই প্রজনন ঘটছে কি না, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।’
কার্শিয়াংয়ের পাহাড়ি রাস্তায় ফের একবার দেখা মেলা ‘কালো চিতাবাঘ’টি রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে যায়৷ কালো চিতাবাঘের সেই ভিডিয়ো প্রকাশ হতেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকার গ্রামগুলোতে৷ স্থানীয়রাই খবর দেন কার্শিয়াং বন বিভাগকে৷
এর আগেও কার্শিয়াং, মানেভঞ্জন এলাকায় ‘কালো চিতাবাঘ’ দেখা গেছে একাধিকবার। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন,অনেক সময় জেনেটিক কারণে লেপার্ডের শরীরের রঙ কালো হয়ে থাকে। সেটিকে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ ভেবে মানুষজন ভুল করতে পারেন। বেশ কয়েকদিন আগে মানেভঞ্জন এলাকায় একটি ব্ল্যাক প্যান্থারের দেহ উদ্ধার হয়েছিল। পরে জানা গিয়েছিল, এলাকার দখল নিয়ে দুটি ব্ল্যাক প্যান্থারের মধ্যে সংঘর্ষে একটির মৃত্যু হয়। সেসময় বাঘটির দেহ উদ্ধার করেছিল বন দফতর।
কয়েক বছর আগে কার্শিয়াং থেকে আট কিলোমিটার দূরে চিমনি এলাকার রাস্তায় একটি কালো চিতার দেখা মেলে। রাতে এক গাড়ি চালক চিমনি এলাকার এক হোম-স্টেতে যাওয়ার সময় ওই ‘কালো চিতা’র ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন। এরপরই গোটা এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। সোশাল মিডিয়ায় মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় ওই ভিডিয়োটি।
পাহাড়ে এর আগেও কালো চিতা বা ম্যালানিস্টিক লেপার্ডের সন্ধান মিলেছে। খবর নেওয়া হচ্ছে। কালো চিতা আসলে চিতাবাঘের একটি জেনেটিক মানের কারণ। যে কারণে চিতার শরীরে কালো রঙের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর আগে ২০২০ সালে মিরিকের ওকাইতি চা-বাগান সংলগ্ন নয় নম্বর ডিভিশনের কাছে রাস্তা পার করার সময় এক কালো চিতার দেখা মিলেছিল। তার আগেও ২০২০ সালেই মিরিকে কালো চিতার দেখা মিলেছিল।
এছাড়াও ২০২২ সালে বক্সার জঙ্গলে এবং জয়ন্তী এলাকাতে ‘কালো চিতা’র দেখা পাওয়া গেছিল। লকডাউনের সময়ে দার্জিলিং শহরেই ক্যামেরাবন্দি হয়েছিল ব্ল্যাক প্যান্থার। উত্তরবঙ্গের নেওড়াভ্যালি এবং বক্সা টাইগার রিজার্ভে আনাগোনা রয়েছে কালো চিতার। ২০২৩ সালের ২৪শে এপ্রিল দার্জিলিংয়ের চিত্রে বাজারের কাছে রাস্তা পার হতে দেখা যায় ‘কালো চিতা’কে। এরপর নভেম্বর মাসেও মিরিকে দেখা গিয়েছিল ‘কালো চিতা’।
মূলত, দার্জিলিং পাহাড় ও ডুয়ার্স এলাকায় চিতাবাঘের সংখ্যা নেহাত কম নয়। চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় চিতাবাঘের সংখ্যা গত কয়েক মাসে প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। তবে অন্যান্য জায়গার তুলনায় মিরিক, কার্শিয়াং, মহানন্দা অভয়ারণ্যে ‘কালো চিতা’ মাঝেমধ্যেই দেখা মিলছে। সেটিও এক গাড়ি চালকের নজরে পড়েছিল। সেই বাঘকে ক্যামেরা বন্দী করেছিলেন গাড়ির চালক। গত ডিসেম্বর মাসে ডাউহিলে একটি লেপার্ড দেখা গিয়েছিল। সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছিলেন, সেখানে মাঝেমধ্যে লেপার্ডে দেখা যায়। কিন্তু, সব সময় সেগুলোকে ক্যামেরা বন্দি করা যায়নি। ২০২২ সালেও বক্সার জঙ্গলে এলাকাতে ব্ল্যাক প্যান্থার দেখতে পাওয়া যায়। ম্যালানিস্টিক লেপার্ডও এর আগেও একাধিকবার দেখা গিয়েছে দার্জিলিঙে। বনকর্তাদের অনুমান ছিল, পাহাড়ে ভালো সংখ্যাতেই রয়েছে লেপার্ড। পাহাড়ি জঙ্গলে কতগুলো লেপার্ডের রয়েছে তা জানতে সুমারি না হলেও এখন ট্র্যাপ ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে বন দফতরের তরফে।
ইতিমধ্যেই রেড পান্ডা প্রজনন এবং সংরক্ষণের জন্যই কিন্তু বিশ্বের দরবারে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে দার্জিলিংয়ের ‘পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক’। আগামী ৭ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ট্যারোঙ্গা চিড়িয়াখানায় অনুষ্ঠিত হবে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ জু’স অ্যান্ড অ্যাকোয়ারিয়ামসের ৭৯তম সম্মেলন। সেখানেই দার্জিলিং চিড়িয়াখানার হাতে তুলে দেওয়া হবে এই সংরক্ষণ স্বীকৃতি।