• facebook
  • twitter
Monday, 21 October, 2024

নাদম’-এর বর্ণময় সঙ্গীতোৎসব

তবলাবাদনে শৌভিক আইচ, শুভ্রনীল ঘোষ,পঞ্চম সান্যাল, ধরতেশ তলোয়ারকর, শ্রবণরাজ সরকার, উপমন্যু ঘোষের কাছে পাওয়া গেল তাদের সুতালিমের নজির। তবলায় সহযোগী শিল্পীদের মধ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ সহযোগিতায় উজ্জ্বল হয়ে রইলেন রোহেন বোস।

প্রবাদপ্রতিম তবলাশিল্পী পণ্ডিত কিষেণ মহারাজের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে নিবেদিত এ বছরের ‘নাদম’ প্রতিষ্ঠানটির বিংশতিতম অনুষ্ঠান (মোহিত মৈত্র মঞ্চ/৭ ও ৮ই সেপ্টেম্বর)। প্রথম দিন অতি উচ্চমানের বাদনকৌশলের অতুলন শৈলীতে মুগ্ধ করলেন কিষেণ মহারাজের শিষ্য – দৌহিত্র শুভ মহারাজ। চমকপ্রদ নিবেদনে ঘরানার কিছু ‘খাস চীজ’, পণ্ডিত রামসহায়, কণ্ঠে মহারাজ, কিষেণ মহারাজের বন্দীশ-রেলা-তেহাই, পঞ্জাব ঘরানার নিহাল সিংজির ‘কামালি’, নাগরখানি রেলা ইত্যাদিতে যেন প্রস্ফুটিত বোল-টুকড়ার সাহিত্য। তবলাবাদনে সমুজ্জ্বল হয়ে রইলেন কুমার বোসের শিষ্য প্রশান্ত দে ও উজ্জ্বল ভারতী। তিনতালে ‘বাজ’-এর স্বচ্ছতা নমনীয়তায় স্ট্রোকের সৌন্দর্য ও শব্দক্ষেপণের নৈপুণ্যে উপস্থাপনা ছিল আকর্ষণীয়। সরোদিয়া ইন্দ্রায়ুধ মজুমদারের পরিবেশ কেদার – আলাপ, ধমার ও দ্রুত ত্রিতাল বন্দীশ। ধীর আলাপ ও জোড়ের বড়হতে স্বরবিন্যাসের সৌন্দর্যে বজায় থেকেছে রাগের গভীরতা ও মাধুর্য। ধমার ও ত্রিতাল বন্দীশে ছন্দবৈচিত্র্যের বোলবাণীর পর ছিল পরিচ্ছন্ন ঝালা। অবন্তী ভট্টাচার্যর শিষ্যা প্রিয়াঙ্কী মিত্র দুটি দাদরায় কহন-বিন্যাস ও যথার্থ মোচড়ে দেখালেন মুন্‌সিয়ানা। ভবিষ্যতে আরও পরিপূর্ণভাবে শিল্পীকে পাওয়ার আশা রইল। গুরু কুমার বোসের তালিমে পাখোয়াজ ও তবলাবাদনে নবপ্রজন্মের কুণাল পাতিল ও সিদ্ধার্থ অবধূত ঠাটের দাপটের পরিবেশন উপভোগ্য। দ্বিতীয় দিন শ্রোতাদের কাছ বড় চমক ছিল অন্তিম উপস্থাপনা – তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের সরোদবাদনের সঙ্গে কুমার বোস ও সরোদিয়া দেবজ্যোতি বোসের তবলাবাদন। তেজেন্দ্রর স্ট্রোকের নমনীয় সৌন্দর্যে রাগ দুর্গার আলাপে শান্ত মাধুর্য, জোড়ের স্বরবিন্যাসে মনোগ্রাহী অলংকরণ এবং একতালে বন্দীশে কুমার বোসের অপূর্ব সহযোগিতায় ছিল ছন্দবৈচিত্র্যে বোলবাণীর অনন্যতা। পরবর্তী দুর্গেশ্বরী (আলি আকবর খান সৃষ্ট) রাগের বোলবাণী আনে ভিন্ন এক মাধুর্য।

এখানে বাহাদুর খাঁর বাদনশৈলীর কিছু বিশেষ অঙ্গ প্রদর্শনের পর বৈচিত্র্যময় ঝালা ছিল আনন্দদায়ক। কুমার বোসের অনবদ্য আলংকারিক ‘বাজ’-এ লয়ের খেলায় এবং দেবজ্যোতির তবলাবাদনের নৈপুণ্যে আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছিল সরোদিয়া ও তবলা শিল্পীদের ‘সওয়াল-জবাব’। গৌড়সারং ও শুদ্ধসারংয়ের লালিত্যপূর্ণ সৌকর্যের সৃজনশীলতার এক অপরূপ নিদর্শন রেখে গেলেন মিতা নাগ। গৌড়সারংয়ের আলাপ গায়কী অঙ্গের স্ট্রোকের মিষ্টত্বে ছিল শ্রুতিনন্দন। শুদ্ধসারং মধ্যলয় ও দ্রুত ত্রিতালে বিষ্ণুপুর ঘরানার বৈশিষ্ট্যময় বোল-বাণী-তানকারি-তেহাই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে বাদনশৈলীর স্বতন্ত্রতায় এবং ঝালায় স্বরনিয়ন্ত্রণের অনন্যতায় পরিবেশন পায় এক অন্য মাত্রা। বেনারস ঘরানার গায়কীর অভিনব প্রদর্শনে শ্রোতাদের বিমুগ্ধ করলেন রীতেশ ও রজনীশ মিশ্র। পিতা রাজন মিশ্রর আঙ্গিকেই মেঘ রাগটি (ঝাঁপতাল/দ্রুত ত্রিতাল) গাম্ভীর্যময় কণ্ঠসম্পদের উৎকৃষ্ট গায়কীতে, বন্দীশ কহনে, স্বরক্ষেপণের চমৎকার কৌশলে যেন মেঘমন্দ্রিত রূপে ঋদ্ধ। রামদাসীমল্লারে একতাল তরানা, ত্রিতাল ও দ্রুত একতালে ছিল চমকপ্রদ তানকারি ও গায়নশৈলী। শেষে ছিল দুটি বিখ্যাত ভজন। মনোগ্রাহী পরিশীলিত বংশীবাদনে , মীড়যুক্ত মাধুর্যময় বিন্যাসে মারোয়ার (ঝুমরা বিলম্বিত, দ্রুত ত্রিতাল) এক বিষণ্ণ সৌন্দর্য বিকশিত পরমানন্দ রায়ের বাদনশৈৈলীতে। পরের সোহিণী দ্রুত ত্রিতালে প্রতিভাসিত উৎকৃষ্ট ঝালা। প্রশংসনীয় তবলাবাদনে চিরঞ্জিৎ মখার্জীর সাথ- সঙ্গত ও সওয়াল- জবাব।

কোটালি ঘরানার অর্চি ভট্টাচার্য গাইলেন মূলতানী (বিলম্বিত একতাল/দ্রুত ত্রিতাল) ও লালিত্যপূর্ণ কিরওয়ানি বন্দীশ। শিল্পীর রাগদারি, স্বরক্ষেপণ, তানকারি প্রশংসনীয়। ভীমপলশ্রীর সৌন্দর্য বজায় রেখেই সরোদে দীপ্তনীল ভট্টাচার্যর ভীমপলশ্রী (বিলম্বিত/ দ্রুত ত্রিতাল/ ঝালা) উল্লেখযোগ্য। তবলাবাদনে শৌভিক আইচ, শুভ্রনীল ঘোষ,পঞ্চম সান্যাল, ধরতেশ তলোয়ারকর, শ্রবণরাজ সরকার, উপমন্যু ঘোষের কাছে পাওয়া গেল তাদের সুতালিমের নজির। তবলায় সহযোগী শিল্পীদের মধ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ সহযোগিতায় উজ্জ্বল হয়ে রইলেন রোহেন বোস। এছাড়া তবলাসঙ্গতে প্রশংসনীয় অভিষেক চ্যাটার্জী, কিশোর কোরডে, কৌশিক দাস, অর্কদীপ দাস, অরুণাভ মজুমদার। হারমোনিয়ামে যথাযোগ্য সহযোগিতায় ছিলেন হিরণ্ময় মিত্র, শঙ্কর বাইন, সজল দাস ও পরমশিবম ঘোষ। দুদিনের অনুষ্ঠানে কুমার বোসের কাছে সুতালিমপ্রাপ্ত বিভিন্ন বয়সী শিষ্যরা প্রত্যেকেই দেখিয়েছে তাদের তালিমগত নৈপুণ্য।