ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর মধ্যে ভারতে সমাজসংস্কার ও জাগরণ ঘটছিল। পরিবর্তনের সুফল পুরুষরা যতটা পেয়েছিল নারীরা ততটা পায়নি। পারিবারিক বাধা না থাকলেও সামাজিক, এমনকি প্রশাসনিক বাধাও ছিল। জাতীয় নেতারা নারীদের নিয়ে তেমন মাথা খাটাতেন না। কর্নেলিয়া সোরাবজী ছিলেন (১৮৬৬-১৯৫৪) এমন একজন মহিলা যিনি একাধারে আইনজ্ঞ, সমাজসংস্কারক ও একজন সুলেখিকা। তিনি ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মহিলা আইন অধ্যয়নকারী এবং ভারত ও ব্রিটেনে ওকালতি করা প্রথম মহিলা। কিন্তু তাঁকে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২০১২ সালে কর্নেলিয়া সোরাবজীর প্রতি সম্মান জানিয়ে লণ্ডনের লিংকনস ইন-এ তাঁর একটি মূর্তির আবরণ উন্মোচন করা হয়। লন্ডনে মর্যাদাপূর্ণ ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারিতে কর্নেলিয়ার একটি আকর্ষণীয় বড় প্রতিকৃতি রয়েছে।
কর্নেলিয়ার কাছে নারী হিসাবে তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাঁর সঙ্গে ভারতের জন্য সমাজসংস্কারমূলক কাজ করা ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর শৈশব কেটেছে বেলগাম এবং পুণেতে। তারপর তাঁকে তাঁর পিতা মিশন স্কুলে ভর্তি করে দেন। পরে ডেকান কলেজে কর্নেলিয়া ১ম মহিলা হিসাবে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কর্নেলিয়ার পিতা সোরাবজী খারসেদজি পারসি ধর্মাবলম্বী হলেও খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর মেয়েদের মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উৎসাহ দিলেও প্রতিবারই তাঁর আবেদন বাতিল হয়ে যেত, কারণ সে সময় মেয়েদের ভর্তির আবেদন মঞ্জুর করা হতো না। কিন্তু সোরাবজী খারসেদজির ষষ্ঠ কন্যা কর্নেলিয়া সোরাবজী সেই বাধা ভাঙ্গলেন। ১৮৮৭ সালে কর্নেলিয়া যখন স্নাতক হন, তখন ডেকান কলেজের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তাঁর প্রাপ্য ছিল বিদেশে পড়তে যাওয়ার বৃত্তি। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সাফ জানিয়ে দেন যে ‘একজন নারীর পক্ষে এরকম ভাবনা ভাবাই অসম্ভব’। কর্নেলিয়া এই প্রসঙ্গে তাঁর অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে লেখেন— যদিও ইউনিভার্সিটি নিয়মাবলী ঘোষণা করেছিল যে নারীরা পুরুষদেরই মতো, আমাকে এই বৃত্তি দেওয়া হয়নি, পরীক্ষা একই রকম ছিল, অন্যান্য আর সকল অবস্থাও ছিল একইরকম কিন্তু কর্তৃপক্ষ বললেন- ‘না কোন মহিলার পক্ষে এ রকম অবস্থা সৃষ্টি করাই স্পর্ধাজনক যা কর্তৃপক্ষের মনেও আসেনি যখন তাঁরা এই পুরস্কার ঘোষণা করেন এবং যখন তাঁরা পুরস্কার প্রাপকদের চোখের সামনে সোনায় মোড়া পুরস্কার তুলে ধরেন তখন তাঁরা স্থির জানতেন সেই চোখ পুরুষেরই চোখ হবে।
শেষ পর্যন্ত কর্নেলিয়া পুণের ও মুম্বইয়ের উল্লেখযোগ্য মহিলাদের আর্থিক সাহায্যে ইংলণ্ডে পড়তে যান। ১৮৮৯ সালে তিনি অক্সফোর্ডে যান এবং সেখানে সমারভিল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে ভারতীয় মহিলা ছাত্রী হিসাবে কর্নেলিয়া নানান স্তরে লিঙ্গবৈষম্য ও তাচ্ছিল্যের শিকার হন। তেমনই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের তরফে তিনি সাহায্য লাভ করে ১৮৯২ সালে Bachelor of civil Law পরীক্ষায় উত্তর্ণ হন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবধি মহিলাদের ডিগ্রি পাওয়ার অধিকার না থাকায় কর্নেলিয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি পাননি। অক্সফোর্ডের পর লন্ডনে এক বছর তিনি একটি আইনের অফিসে সলিসিটারের কাজ শেখেন, কিন্তু সেখানেও তিনি কোনও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। অক্সফোর্ডে তিনি মহান আদর্শবাদী ম্যাক্সমূলার এবং মোনিয়ার উইলিয়ামের সান্নিধ্যে এসে ছিলেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের সঙ্গেও কর্নেলিয়ার স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে উঠে ছিল। ১৮৯৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। সিদ্ধান্ত নেন সারাজীবন অবিবাহিত থাকার। দেশে ফিরে কর্নেলিয়া অধুনা মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৮৯৭ সালে এলএলবি পরীক্ষায় পাশ করেন। ফলে তিনি উচ্চ আদালতে উকিল হিসাবে যোগদান করার যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয় এই বলে, ‘এমন কি কোনও মহিলাকে দেখাতে পারেন যিনি আগে উকিল হয়েছেন? একটি মাত্র দৃষ্টান্তই যথেষ্ট হবে’। মুম্বই উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি বলেন ‘একজন মহিলার আইন সম্পর্কে কিছু করার থাকতেই পারে না’।
এরপর কর্নেলিয়া এলাহাবাদ উচ্চ আদালতে আইন ব্যবসার সুযোগ সন্ধান করেন। কিন্তু এখানেও বাধা পান। তাঁকে বলা হয় আদালতে আইনজীবী হিসাবে নাম নথিভুক্ত করতে হলে উর্দু ও শিখান্ডা দুটি ভাষা অধ্যয়ণ করতে হবে। কর্নেলিয়া দুটি ভাষা আয়ত্ত করেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সি. জে. এজ বলেন, পুনর্বিবেচনা করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ভারতীয় উচ্চ আদালতের পক্ষে কোন নারীকে আদালতের আইনজীবীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত স্পর্ধাজনক হবে। কর্নেলিয়া এতে দুঃখিত হলেও হতাশ হননি।
এমতবস্থায় কর্নেলিয়া আইনের জগতে প্রবেশের জন্য এক নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশীয় রাজপরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন রাজ্যের (native and princely states) নারীদের, যাঁদের তিনি পর্দানশীন বলে অভিহিত করতেন, তাঁদের আইনের অধিকারের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও খবরের কাগজে লিখতে শুরু করেন। তিনি বলেন, পর্দানশীন নারীদের জন্য যেমন মহিলা ডাক্তারদের প্রয়োজনীয়তা আছে তেমনই তাঁদের আইনের সাহায্যের জন্য প্রয়োজন মহিলা আইনজ্ঞের। এই প্রস্তাব তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে উপস্থাপনা করেন। তাঁর এই প্রস্তাব ১৯০১ সালে অনুমোদিত হয় ও বাংলা, বিহার ও ওড়িশার বিভিন্ন জমিদারি তালুকের অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের আইনের সাহায্য প্রদানের জন্য তাঁকে Lady Legal Adviser to the Court of Wards-এর পদে নিযুক্ত করা হয়। দীর্ঘ দু-দশক (১৯০১-১৯২২) কর্নেলিয়া এই পদে নিযুক্ত থাকেন। বেতন, পেনশন, কাজের স্বীকৃতি এমন সব বিষয়েই একজন ভারতীয় নারী হিসাবে কর্নেলিয়াকে বার বার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে হয়েছিল।
১৯২২ সালে কর্নেলিয়া ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে মহিলারা আইনের ডিগ্রি প্রাপ্তির ও আইন ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার অধিকার লাভ করেন। ওই বছর কর্নেলিয়া এলাহাবাদ হাইকোর্টে উকিল হিসাবে তাঁর নাম নথিভুক্ত করেন। কিন্তু তিনি প্রথম ভারতীয় মহিলা ব্যারিস্টার হওয়ার স্বীকৃতি পাননি কারণ তৎকালীন চাকুরী থেকে অবসর না পাওয়ার ফলে তাঁর থেকে বয়সে অনেক ছোট মিথান টাটা (১৮৮৯-১৯৮১) হন প্রথম ভারতীয় মহিলা ব্যারিস্টার। প্রথম মহিলা হিসাবে তিনি মুম্বাই হাইকোর্টে অনুশীলন করেন। বয়সের দিক থেকে কর্নেলিয়া অনেকটা প্রবীণ হলেও ১৯২৪ সালে নতুন উদ্যমে কলকাতা উচ্চ আদালতে আইনজ্ঞ হিসাবে তাঁর নাম নথিভুক্ত করেন। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তিনি বন্ধু ইলিনাকে চিঠিতে লিখে জানাতেন। এমনই একটা চিঠিতে কর্নেলিয়া এলাহাবাদ হাইকোর্টের একটি ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর প্রতিপক্ষ আইনজ্ঞ ছিলেন স্যার তেজ বাহাদুর সাপরু। পক্ষ-প্রতিপক্ষ আইনি তর্কের ক্ষেত্রে সাপরু কর্নেলিয়ার উদ্দেশ্যে বলেন, আমার শিক্ষিত বন্ধু বোধ হয় উপলব্ধি করতে পারছেন না যে, আদালতে কাব্যিক কল্পনা নয়, আইনই বিরাজ করে। তাঁর (সোরাবজীর) মামলাটি একটি পত্রিকার জন্য লেখা কাল্পনিক রাজপুত্রের গল্প হিসাবে খুব ভাল লেখা হতে পারে, তবে আমি স্বীকার করব যে, তিনি ইংরেজি জানেন কিন্তু আর কিছুই জানেন না।
কর্নেলিয়ার কর্মপ্রয়াস কেবল আইনের পেশার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না, সমাজসেবার কাজেও তিনি যুক্ত ছিলেন। পর্দানশীনদের নিয়েই তিনি সমাজসেবামূলক কাজের পরিকল্পনা করেন। ১৯২৯ সালে কর্নেলিয়া হাইকোর্ট থেকে অবসর নেন। সেই বছর তিনি Bengal League of Social Service for Women নামক এক সংস্থা গঠন করেন। পেশাগতভাবে তিনি সমাজসেবার কাজকে ভারতীয় ও ব্রিটিশ নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। সেই সঙ্গে আশা করেছিলেন শুধু শহরে নয় গ্রামে গিয়ে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের জন্য সমাজকর্মীরা কাজ করবে। তাঁদের মনের নানান কুসংস্কার দূর করতে সাহায্য করবে এবং সেই সব মহিলাদের বিভিন্ন পেশার কাজে দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ দেবে। কর্নেলিয়া ৬০০ মহিলা এবং অনাথদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করেছিলেন। বাংলা, বিহার ও আসাম জুড়ে তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিব্যাপ্ত ছিল। কর্নেলিয়া মনে করতেন কখনও কোন পরিবর্তনকে, তা যে যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, কারও ওপর চাপিয়ে দিলে তার কাঙ্ক্ষিত ফলে পাওয়া যায় না।
তিনি কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিলেন নারীদের আবেগপ্রবণকে, অন্ধভাবে কোনও নেতাকে অনুসরণ করাকে ও গঠনমূলক কাজের পরিবর্তে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানকে, তবে সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির টানাপোড়েনে ও ক্যাথরিন মেয়োকে কেন্দ্র করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার ফলে কর্নেলিয়ার সোশাল সার্ভিস লিগ আর কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি। তাঁর কাজের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত সরকার ১৯০৭ সালে তাঁকে ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পুরস্কারে ভূষিত করে।
আমেরিকান লেখিকা ক্যাথরিন মেয়োর Mother India (1927) গ্রন্থ নিয়ে ভারতবর্ষ তখন তোলপাড়। কর্নেলিয়া তাঁকে সমর্থন করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনে বিরোধিতা করেন এবং তাঁর রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের জন্য ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। ফলে কর্নেলিয়া ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতাদের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৩১ সালে গান্ধীজি লণ্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে গেলে, কর্নেলিয়া তখন তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে একটি ব্রিটিশ জার্নালে তাঁর সাক্ষাতের অনুমতি নিয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীর সঙ্গে বিরোধের কারণে সাক্ষাৎকারটি মাঝপথে স্থগিত হয়ে যায়। তবে সাক্ষাৎকারের বিবরণটি ব্রিটিশ এবং ভারতের সব সংবাদপত্রে তা ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। অবশেষে ১৯৩১ সালে তিনি ভারত থেকে লণ্ডনে ফিরে যান। শীতকালে মাঝে মধ্যে তিনি ভারতে আসতেন। লণ্ডনেই ১৯৫৪ সালে ৮৮ বছর বয়সে কর্নেলিয়া সোরাবজী প্রয়াত হন।