• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

আমার পকেটের কতকগুলা টাকা পয়সা বিছানাতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, দেখি যে, সেই কুলিরা সেই সব কুড়াইয়া আনিয়া আমাকে দিল।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর

আমি এখন সেই দোলায় চড়িয়া ডগশাহী নামক আর একটা পর্ব্বতে চলিলাম। সমস্ত দিন চলিয়া সন্ধ্যার সময় কুলিরা আমাকে একটা প্রসবণের নিকটে রাখিয়া জল খাইতে বসিল, এবং তাহারা পরস্পর কথাবার্ত্তা ও হাস্য পরিহাস করিতে লাগিল। আমি তাহাদের কথা কিছুই বুঝিতে না পারিয়া ভাবিলাম যে, ‘ইহারা হয় তো আমাকে মারিয়া ফেলিয়া এই সকল টাকা লইবার জন্য পরামর্শ করিতেছে। ইহারা এখন জনশূন্য অরণ্য হইতে আমাকে খদে ফেলিয়া দিলে আর কেহই জানিতে পারিবে না।’ এ কেবল আমার মনের বৃথা আতঙ্ক। তাহারা জল পান করিয়া পুনর্ব্বার সবল হইয়া আমাকে একটা বাজারে লইয়া দুই প্রহর রাত্রিতে নামাইল।

সেখানে রাত্রিযাপন করিয়া আবার চলিতে লাগিলাম। আমার পকেটের কতকগুলা টাকা পয়সা বিছানাতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, দেখি যে, সেই কুলিরা সেই সব কুড়াইয়া আনিয়া আমাকে দিল। তাহাতে উহাদের উপরে আমার বড়ই বিশ্বাস জন্মিল। আমি মধ্যাহ্নকালে ডগশাহীদে পঁহুছিলাম। তাহারা আমাকে একটা খোলার ঘরে নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। কিশোরী সন্ধ্যার সময় আমার কাছে পঁহুছিল। খদের ধারে একটা গোয়ালার বাড়ীর উপরে একটা ভাঙ্গা ঘর থাকিবার জন্য পাইলাম, এবং শয়নের জন্য একখানা দড়ির খাটিয়া পাইলাম। ইহাতেই সেই রাত্রি যাপন করিলাম।

তাহার পর আমি সকালে উঠিয়া পর্ব্বতের চূড়াতে চলিয়া গেলাম। দেখি, সেই চূড়াতে মদের খালি বাক্স বসাইয়া গোরা সৈন্যেরা এক চক্রাকৃতি কেল্লা নির্ম্মাণ করিয়াছে। তাহার মধ্যে একটা পতাকা উড়িতেছে, তাহার নীচে একটা গোরা একটা খোলা তরোয়াল লইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। আমি আস্তে আস্তে সেই বাক্সের প্রাচীর লঙ্ঘন করিয়া সেই কেল্লার মধ্যে প্রবেশ করিলাম, এবং অতি ভয়ে ভয়ে সেই গোরার কাছে গেলাম। মনে করিলাম, এ-বা আমার উপরে তাহার তলওয়ার চালায়। কিন্তু সে অতি মলিন ও বিষণ্ণভাবে আামাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘গুর্খারা কি এখানে আসিতেছে?’ আমি বলিলাম, ‘না, এখনো এখানে আসে নাই.’ আমি সেখান হইতে বাহিরে আসিলাম, এবং খুঁজিয়া একটু ক্ষুদ্র গুহা পাইলাম, তাহার মধ্যে ছায়াতে বসিয়া রহিলাম। সন্ধ্যাকালে নীচে পর্ব্বতে আসিয়া সেই গৃহে শয়ন করিলাম। সেই রাত্রিতে অল্প বৃষ্টি হইল; আর সে ঘরের ঘরত্ব থাকিল, না ভাঙ্গা ছাদ দিয়া জল পতে লাগিল। এই প্রকারে আমার সেই বনবাসে দিন রাত্রি কাটিয়া যাইত।

কাবুল লড়াইয়ের ফেরতা ঘোষজা ও বসুজা দুই জন এই ডগশাহীতে এখন ডাকঘরের কর্ম্ম করেন। তাঁহারা আমার সঙ্গে দেখা করিতে আইলেন। বসুজা বলিলেন, ‘‘আমি কাবুলের লড়াই হইতে বড় বেঁচে এসেছি। পলাইয়া আসিবার সময় কাবুলের পথে একখানা শূন্য ঘর দেখিতে পাইয়া আমি তাহার মধ্যে প্রবেশ করিলাম, এবং একটা মাচার উপর উঠিয়া লুকাইয়া রহিলাম। সেখানে কাবুলীরা আমাকে দেখিতে পাইয়া মারে আর কি। অনেক কষ্টে বাঁচিয়া আসিয়াছি। আবার এখন এই বিপদ!’

আমি সেখানে যে কয়দিন ছিলাম, প্রতিদিন ঘোষজা আমার তত্ত্ব লইতেন। আমি একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ঘোষজা, আজিকার খবর কি?’ তিনি বলিলেন, ‘আজিকার খবর বড় ভাল নয়।